বড়লেখায় বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী বাঁশ ও বেত শিল্প
হানিফ পারভেজ
বড়লেখা, মৌলভীবাজার
মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা থেকে ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী বেতশিল্প। এক সময় গ্রামীণ জনপদের মানুষ গৃহস্থালি, কৃষি ও ব্যবসা ক্ষেত্রে বেত-বাঁশের তৈরি সরঞ্জামাদি ব্যবহার করত। কিন্তু এখন উপজেলায় বেতের তৈরি পণ্যের আর কদর নেই বললেই চলে। ফলে বিলুপ্তির পথে শিল্পটি।
এ কারণে গ্রামের হাটবাজারগুলোতে বাঁশ-বেতের তৈরি শিল্প আগের মতো আর চোখে পড়ে না। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত থাকা পরিবারগুলো এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সঠিক সময়ে রোপণ, প্রয়োজনীয় পরিচর্যা, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিকল্পনার অভাবে মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার বাঁশ ঝাড় উজাড় হয়ে যাচ্ছে। ফলে এলাকা থেকে বাঁশ-বেত নির্ভর শিল্প এখন হারিয়ে যেতে বসেছে।
এলাকা সূত্রে জানা যায়, একসময় গ্রামের হাটবাজারগুলোতে বাঁশের তৈরি অনেক ধরনের হস্ত শিল্প বিক্রি হতো। যেমন কুলা, ডালা, টুকরি, ছাইন,,ডরি, মই, মাছ ধরার জোলঙ্গা, পলো এবং বিভিন্ন শৌখিন খেলনা সামগ্রী।
এ ছাড়াও এলাকায় কাঁচা ঘর তৈরিতে বাঁশের খুঁটি, বেড়া, ঘরের দরজা ইত্যাদি উপকরণও ব্যবহার হতো।
এ বিষয়ে বাঁশের তৈরি শিল্প বিক্রেতা তালিম পুর ইউনিয়নের আখালিমুরা গ্রামের লালমোহন বলেন, ‘আগে বাঁশের তৈরি জিনিসপত্র নিজেরা বাড়িতে তৈরি করে বাজারে বিক্রি করেছি, তখন লাভ হতো। কিন্তু এখন তেমন লাভ হয় না। রাত-দিন খেটে যা তৈরি করি হাটবাজারে সে তুলনায় বিক্রি নেই। সরকারি ভাবে কোনো সাহায্যে সহযোগিতাও পাচ্ছি না। অনেক দুঃখ কষ্টে দিন কাটছে আমাদের। অভাবের তাড়নায় গোত্রের অনেকেই অন্য পেশায় চলে গেছেন। উপযুক্ত কাজ এবং অভিজ্ঞতার অভাবে আমরা অন্য পেশায় যেতে পারিনি।’তিনি ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে বাঁশ ও বেত শিল্পীরা সরকারী বা বেসরকারীভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং সুদমুক্ত ঋণ দিতে সরকারের কাছে জোর দাবী জানান।
বর্তমানে স্বল্প দামে হাতের নাগালে প্লাস্টিক সামগ্রী পাওয়ায় কুটির শিল্পের চাহিদা আর তেমন নেই। এক সময় পল্লিতে বাঁশ ও বেত ঝাড় থাকায় বাঁশের তৈরি শিল্পের প্রচুর ব্যবহার ছিল। কিন্তু আগের মতো এখন বাঁশ, ঝাড় আর বেত চোখে পড়ে না। এর দুষ্প্রাপ্যতার কারণে একদিকে যেমন গ্রামীণ অর্থনীতির চালিকা শক্তি কুটির শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তেমনি নিঃস্ব হচ্ছে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী পরিবারগুলো।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান: প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর ও প্রাকৃতিকভাবে সমৃদ্ধ বনাঞ্চল। এটি মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত এবং ১৯৯৬ সালে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। প্রায় ১,২৫০ হেক্টর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এই উদ্যানটি বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
উদ্যানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য:
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের চারপাশে রয়েছে সবুজে ঘেরা পাহাড়ি বন। বড় বড় গাছপালা, বাঁশঝাড়, লতা-গুল্ম এবং ঝরনাধারা মিলে উদ্যানটি এক অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে। ঘন সবুজ বনের ভিতর দিয়ে পায়ে হাঁটার সরু রাস্তা পর্যটকদের মনোরম অভিজ্ঞতা প্রদান করে। সকালে কুয়াশার চাদরে ঢাকা এই বন মনে হয় এক স্বপ্নময় রাজ্য।
জীববৈচিত্র্য:
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানটি বন্যপ্রাণীর জন্য বিখ্যাত। এখানে রয়েছে ২৬ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ২৪৬ প্রজাতির পাখি, ৬ প্রজাতির উভচর এবং ২০ প্রজাতির সরীসৃপ। উল্লুক, চশমাপরা হনুমান, মাকাক বানর, কাঠবিড়ালীসহ বিভিন্ন স্তন্যপায়ী প্রাণী দেখা যায়। এছাড়া হরিয়াল, ময়না, কাঠঠোকরা, শ্যামা, বুলবুলি সহ বিভিন্ন রকমের পাখির কাকলি বনটিকে আরও জীবন্ত করে তোলে।
পর্যটন ও ভ্রমণ:
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান পর্যটকদের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় স্থান। এখানে ভ্রমণপিপাসুরা গাইডের সাহায্যে বনের বিভিন্ন ট্রেইল ঘুরে দেখতে পারেন। স্থানীয় আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও জীবনধারার সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগও রয়েছে। ট্রেনলাইন দিয়ে ছুটে চলা ট্রেন, সবুজ বনের মধ্যে দিয়ে হাঁটা, পাখিদের গান—এসব মিলে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হয়।
সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ:
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের জীববৈচিত্র্য বর্তমানে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বনের ভিতর দিয়ে ট্রেনলাইন চলে যাওয়া, পর্যটকদের অসচেতনতা, অবৈধ বন উজাড় ইত্যাদি কারণে উদ্যানের প্রাণী ও পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এসব সমস্যা মোকাবেলায় প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপ এবং পর্যটকদের সচেতনতা বৃদ্ধি জরুরি।
উপসংহার:
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান শুধুমাত্র একটি পর্যটন কেন্দ্র নয়, এটি বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং জীববৈচিত্র্যের একটি অনন্য নিদর্শন। এই উদ্যানের সুরক্ষা ও সংরক্ষণে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। প্রকৃতির অপার মহিমা অনুভব করতে হলে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান একবার হলেও ভ্রমণ করা উচিত।